রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০২ অপরাহ্ন
মুফতি শরিফুল আজম:
আত্মপ্রশংসা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। সুযোগ পেলেই আমরা আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাই। নিজের অর্জন, গুণাগুণ, কর্মতৎপরতা নিয়ে আত্মতুষ্টির ঢেকুর তুলি। সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক দ্বীনদার-পরহেজগারের মধ্যেও ইখলাস (একনিষ্ঠতা) বিনষ্টকারী ও আমল বিধ্বংসী এই রোগ ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। অথচ এটা সবারই জানা যে, মানুষের কাছে নিজের বড়ত্ব প্রকাশ কিংবা আত্মপ্রচারে লিপ্ত হওয়া নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য কোনো আচরণ নয়। কোনো সচেতন মানুষ তা ভালো চোখে দেখে না। এমনকি স্বয়ং আত্মপ্রশংসাকারী ব্যক্তিও অন্যের আত্মপ্রশংসাকে নিন্দনীয় দৃষ্টিতেই দেখেন। অতএব একজন আল্লাহভীরু ও ব্যক্তিত্ববান মানুষকে অবশ্যই এই অপছন্দনীয় আচরণের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, যা একাধারে নিজের ব্যক্তিত্বকে নষ্ট করে অপরদিকে সৎআমলকেও ধ্বংস করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আত্মপ্রশংসায় লিপ্ত হয়ো না। কারণ তিনি সর্বাধিক অবগত কে আল্লাহকে ভয় করে।’ সুরা নাজম : ৩২
একজন নেককার ব্যক্তির জন্য বড় পাপ হলো আত্মপ্রশংসা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি তোমরা পাপ না করো, তাহলে আমি তোমাদের জন্য এর চেয়ে বড় পাপের আশঙ্কা করি। আর তা হলো আত্মঅহমিকা।’ বাজযার : ২৯২১
বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় মানাবি (রহ.) বলেন, পাপী ব্যক্তি নিজের ত্রুটি স্বীকার করে। ফলে তার পক্ষ থেকে তওবার আশা করা যায়। কিন্তু আত্মগর্বী ব্যক্তি নিজের আমলের দ্বারা প্রতারিত হয়। ফলে তার তওবার সুযোগ সুদূর পরাহত হয়ে যায়। মানাবি, ফায়যুল কাদির শারহু জামেঈছ ছাগির : ৫/৩৩১
মুহাম্মাদ ইবনে আমর (রহ.) থেকে বর্ণিত, যয়নব বিনতে আবী সালামা (রা.) তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার মেয়ের কী নাম রেখেছ? তিনি বললেন, বাররাহ (পুণ্যবতী)। তিনি বললেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ ধরনের নাম রাখতে নিষেধ করেছেন। আমার নামও বাররাহ রাখা হয়েছিল। নবী কারিম (সা.) বললেন, তোমরা নিজেদের পরিশুদ্ধ দাবি করো না। কেননা আল্লাহই ভালো জানেন, তোমাদের মধ্যে কে পুণ্যবান। অতঃপর তিনি বললেন, আমি এর কী নাম রাখব? নবী কারিম (সা.) বললেন, এর নাম রাখো যয়নাব। সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৫৩
প্রশংসা পাওয়ার আকাক্সক্ষা আমাদের নেক আমলগুলোকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মর্যাদার বিচার করা হবে, সে হচ্ছে এমন একজন যে দুনিয়াতে শহীদ হয়েছিল। আল্লাহতায়ালা তার আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, আমি তোমার পথেই যুদ্ধ করেছি এমনকি শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি বরং এ জন্যেই যুদ্ধ করেছিলে যাতে লোকেরা তোমাকে ‘বীর’ বলে আখ্যায়িত করে। আর তোমাকে তা বলা হয়েছে। অতঃপর তাকে উপুড় করে হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। সহিহ মুসলিম : ১৯০৫
এক ব্যক্তি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ওই ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি কী বলেন, যে জিহাদ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সুনাম-সুখ্যাতি উভয়টিই কামনা করে। তার জন্য কি প্রতিদান রয়েছে? হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তার জন্য কিছুই নেই। এই প্রশ্ন তাকে তিনবার করা হলেও তিনি একই জবাব দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহতায়ালা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা নিষ্কলুষভাবে কেবল তার জন্যই করা হয় এবং যার মাধ্যমে শুধুমাত্র তারই সন্তুষ্টি কামনা করা হয়। সুনানে নাসাঈ : ৩১৪০
আত্মপ্রশংসার প্রবণতা মানুষের মধ্যে আসে আত্মঅহংকার থেকে, যা অত্যন্ত ঘৃণিত আচরণ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি অহংকারবশে মানুষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং জমিনে উদ্ধতভাবে চলাফেরা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিক ও অহংকারীকে ভালোবাসেন না। সুরা লোকমান : ১৮
অহংকারের কারণে মানুষের আমল সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে জান্নাতের পথ থেকে দূরে সরে যায়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ অহংকার আছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ মিশকাত : ৫১০৭
তিনি বলেন, তিনটি বিষয় ধ্বংসকারী ১. প্রবৃত্তি পূজারী হওয়া ২. লোভের দাস হওয়া এবং ৩. আত্মঅহংকারী হওয়া। আর এটিই হলো সবচেয়ে মারাত্মক। মিশকাত : ৫১২২
অতএব আসুন! সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আত্মপ্রশংসা ও আত্মপ্রসাদ থেকে বাঁচার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করি। বরং নিজেদের নেক আমলগুলো পারতপক্ষে গোপন রাখার চেষ্টা করি, যাতে তা শেষবিচারের দিনে আল্লাহর খাতায় লেখা থাকে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কিছু গোপন নেক আমল সঞ্চয় করে রাখতে পারলে সে যেন তা করে।’ সিলসিলা সহিহাহ : ২৩
ভয়েস/আআ